নুরুল আমিন হৃদয় :
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে মরিচ খায় কাউয়ায় আর জ্বলে শালিকের। আমাদেরও হয়েছে সেই দশা।
খেলা চলে রাশিয়ায়। আর নাওয়া-খাওয়া কাজ-কর্ম ফেলে নেচে কেঁদে ঘেমে-নেয়ে একাকার হই আমরা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রতি আমাদের যতটা দরদ ততটুকু দেশপ্রেম বোধ হয় সেই দেশের নাগরিকদেরও নেই! নিজের গায়ের পুরনো জামা তাতে ক্ষতি নেই ! মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে জমানো সে টাকা নিয়ে পতাকা বিক্রেতার কাছ থেকে প্রিয় দলের পতাকা কিনবেন। ব্রাজিলের পতাকা টানাতে কমপক্ষে ২০ ফুট বাঁশ চাই। পতাকার সাইজটাও বড় হওয়া চাই। আর পাশের বাড়িওয়ালার পোলা যেহেতু আর্জেন্টিনার ভক্ত। সে আরো ৫ ফুট বেশি নিয়ে ২৫ ফুট আর্জেন্টিনার পতাকা বানাবেন। এখানেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার লড়াই। বাসা-বাড়ির ছাদে, দোকানে, সিনেমা হলে শপিং মলে-বাসে, প্রাইভেট কার, সিএনজি রিকশায় উড়বে তাদের পছন্দের দলের পতাকা।
বাসের সুপারভাইজার আর্জেন্টিনা। যাত্রী যদি তার আর্জেন্টিনার সমর্থক হয় দেখা যাবে দুই টাকা কম দিলে কিছু বলবে না আর ব্রাজিল হলে বেচারার কপালে দুঃখ। তার কাছে ভাংতি টাকা না থাকলেও এক টাকা কম নিবে না।
কিছুদিন আগে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল প্রীতি ম্যাচ হয়ে গেল। পাশের বাড়ির হালিম সাহেবের স্ত্রী ব্রাজিলের মারকুটে ভক্ত। হালিম সাহেব যদিও এসব নিয়ে বেশি মাতামাতি করেন না। বৌ যেহেতু ব্রাজিল তাই তিনি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করলেন।
খেলায় আর্জেন্টিনার কাছে ব্রাজিল (১-০) গোলে হেরে গেলো। হালিম সাহেব বেশ ফুরফুরে। ভাবী কড়া মেজাজ নিয়ে কুড়কুড়ে। খুশিতে গুনগুনিয়ে গানও গাইছেন হালিম সাহেব। পরদিন সকালে হালিম সাহেবের টেবিলে নাস্তার খবর নেই। হালিম সাহেব একটু মিনমিনিয়ে ভাবীকে বললেন-
একটু নাস্তাটা দাওনা। ভাবীতো রীতিমত তেলে বেগুনে। গলায় ঝাঁঝ মার্কা কন্ঠ স্বরে বললেন তোমার আর্জেন্টিনাকে বলো খাবার পাঠাতে।
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দলের সমর্থকরা তাদের প্রিয় খেলোয়াড়দের খোঁজ নেন খুব আগ্রহ ভরে। সকাল বেলায় প্রথমে পত্রিকা হাতে নিয়ে জানতে চান নিজ দলের তারকাদের নিয়ে কে কি লিখলো, কোন খবর আছে কীনা। পর্তুগালের রোনালদোর প্রেমিকার নাম কি? নাইজেরিয়ার খেলোয়াড় কানু কোন কোম্পানীর বিড়ি খান? ব্রাজিলের সাবেক কোচ ‘ডুঙ্গা’ পান খান কিনা, খাইলে সাথে কোন কোম্পানীর জর্দা খান। জার্মানির মাইকেল বালাক মাথায় কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করেন ? নেইমার খালি পেটে চা খান কীনা, মেসি যে নাপিতের কাছে চুল কাটায় সে নাপিতের মাসিক আয় কত, ব্রাজিলের খেলোয়াড় কাকাকে তার বৌ ও কি কাকা বলে ডাকেন। সব তথ্য যেন জানতে হবে।
আমাদের সবার ভাব দেখে মনে হয় সামনে কোনো বিসিএস পরীক্ষা আছে। তাই এসব খবর যেন জানতেই হবে। না জানতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে পেটের ভাত যে হজম হয় না।
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমরা বাংলাদেশে যত মাতামাতি করি, ব্রাজিলে কিংবা আর্জেন্টিয়ানরা তাদের দেশের মানুষ খেলা নিয়ে এত মাতামাতি করেন কীনা সন্দেহ আছে।
কয়েক বছর আগে বিশ্বকাপ কভার করতে যাওয়া আমাদের দেশের একজন সাংবাদিক লিখেছেন বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়ান এবং আর্জেন্টিয়ানরা তাদের নিজ দেশের খেলা বাদে অন্য খেলাগুলোর খবর রাখে না। আমাদের মতো সব দেশের খেলোয়াড়দের নামধাম বংশ-ক্লাব পরিচয় এরা মুখস্থ করে বসে নেই এবং এদের সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় রোজ বিশ্বকাপের খবরই একমাত্র খবর নয়। তারা তাদের দেশের নিজেদের আয়-উন্নতি, জীবন-সংগ্রাম নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত।
ফুটবল বিশ্বর দুই পরাশক্তি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা প্রতিবেশী। প্রতিবেশী বলে তাদের সবকিছুতে অনেক বেশি ঘেঁষাঘেঁষি, রেষারেষিও বেশি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্ধিতা প্রায় শত্রুতার পর্যায়ে চলে গেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা মহাকাশ গবেষণায় তারা বহু ক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেলেও, ফুটবলে তাদের এখনো দা-কুমড়ো সম্পর্ক। এ দুটি দল ১৯৩৯-৪০ থেকে এখনও পর্যন্ত ফুটবল মাঠের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইকে হাড্ডি ভাঙার লড়াইয়ে যেন পরিণত করেছেন।
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশিদের কেউ নয়। তাদের পরাজয়ে বহু বাংলাদেশি কাঁদেন, আবার বিজয়ে হাসেন।
মনে প্রশ্ন জাগে না আর্জেন্টিনা কে আমার? যেমন ধরি ৯০এ আর্জেন্টিনা যখন হেরে গেলেন তখন বাংলাদেশের অনেক জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘ম্যারাডোনার চোখের জল বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছে’। আবার গত বিশ্বকাপে ট্রাইবেকারে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে মেসির কান্নায় বাংলাদেশের অনেক আর্জেন্টিনা প্রেমিককে ব্যথিত করেছে। তেমনি ব্রাজিল সমর্থকদেরও ব্যথিত করেছে জার্মানির কাছে বড় ব্যবধানের পরাজয়।
আমাদের দেশে এ দুটি দলের সমর্থক অনেক বেশি। আমরা যে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ।
একবার ব্রাজিল বিশ্বকাপে আমাদের দেশের এক প্রবাসী ‘আর্জেন্টিনা’ ‘আর্জেন্টিনা’ বলে এমন চিৎকার করেছিলেন যে আশপাশের সবাই চমকে তাকিয়েছিল। আসলে ফুটবল কত অচেনা বা দূরের ভিন্ন দেশের মানুষকেও আত্মীয় করে তোলেন!
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কত কল্পকাহিনী আছে।
খেলা হয় জার্মানিতে আমাদের দেশের দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে চলে তর্কাতর্কি, হাতাহাতি, ধাক্কা-ধাক্কি ও মাথা ফাটাফাটি। অনেকেই আছেন গত চার-পাঁচ বছরেও যে মানুষটির সাথে বনিবনা ছিলো না বিশ^কাপ এলে তার সঙ্গে বেশ খাতির জমে যায়, কারণ দুজনযে একই দলের সমর্থক। তাদের এ গলাগলি দেখে বিপক্ষ দলের সমর্থকরা টিপ্পনি কাটেন। দেখছো, এতদিন কথা বলে না, এখন দুজনের মধ্যে কি .. খাতির। বিশ্বকাপটা যাক না! এরপর দুজন একে অপরের জন্য লাঠি নেবে। খেলা চলাকালীন যদি বিদ্যুৎ চলে যায় কেউ না কেউ মন্তব্য করে ফেলবে। এ বিদ্যুৎ অপারেটর তার দল গোল খাওয়ায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছে। সে নিশ্চয় ঐদলের সমর্থক।
আমাদের দেশের সমর্থকদের মধ্যে এরকম মন্তব্য ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও জার্মানিদের সাপোর্ট করে তর্কাতর্কি আজীবন চলবে।
এবার দেখুন ফুটবলের ভাষায় বোনের কাছে পাঠানো এক নারীর চিঠি। চিঠিটা ছিল এরকম-
প্রিয় বড় আপু,
আমার সালাম নিবেন। গত কয়েক মাস থেকে আমার উপর যৌতুক (বল) শর্ট কিক শুরু হয়েছে। আমার শ্বাশুরি আম্মা, শ^শুর আব্বা পর্তুগালের রোনালদো থেকেও যেন সেরা স্ট্রাইকার। আমার স্বামী মানে তোমাদের বোন জামাই মিডফিল্ডে সেরা খেলোয়াড়। আমার দেবর ডিপেন্সে হান্নান কেসপো থেকেও বড় শর্ট খেললেও আমার সামনে আসলে তার ভয়ে হাঁটু কাঁপে। অতিরিক্ত খেলোয়াড় তালিকায় থাকা আমার একমাত্র ননদীনির একেকটা শর্টে আমি প্রতিনিয়ত জর্জরিত হচ্ছি। অবাক লাগে! এ বয়সে এসেও আমার সত্তরোর্ধ্ব নানী শ্বাশুরি নেইমার থেকেও জোরে (প্যাঁচ) বল করেন। শর্টে আমার মামী শ^াশুরিও পিছিয়ে নেই। তাদের প্রতিটি শর্টে মাঝে মধ্যে বিব্রতবোধ হলেও অতীব ধৈর্য্য এবং বুদ্ধিমত্তার সহিত তাদের প্রতিটি বল মোকাবেলা করে আসছি। কোনো কোনো সময় ক্লান্তি বোধ করলেও এখন পর্যন্ত খেলায় পিছিয়ে নেই। ১০০ ১০০ খেলছি।
এখানে বাড়ির ইজ্জত আলী চাচা মাঝে মাঝে রেফারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাদের লালকার্ড কিংবা হলুদ কার্ড দেখাতে পারেননি।
আমি তোমার (প্রধান কোচের) দিক নির্দেশনা অনুযায়ী- তাদের প্রতিটি বলের মোকাবেলা করে আসছি। দোয়া করো আপু পুরো ৯০ মিনিট (আজীবন) ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এ ম্যাচে আমার (শ্বশুর বাড়িতে) সুন্দর খেলাটা (আচার-আচরণ ও ধৈর্য্যরসহিত) খেলে একজন সেরা গোলরক্ষক (আদর্শ বৌ) হিসেবে সাফল্য লাভ করতে পারি। এবং গোল্ডেন বল জিততে পারি।
আমার কোন বিতর্কিত (ভুলের জন্য) খেলার কারণে যাতে লাল কার্ড (তালাক) পেয়ে বাপের বাড়িতে না যেতে হয়।
ইতি-
তোমার ছোট বোন
কমলা সুন্দরী।
এইতো গেলো কমলা সুন্দরীর কথা।
এবার শুনুন এক চাচার লুঙ্গির কাহিনী। চাচা অনেক শখ করে বাজার থেকে সাদা রংয়ের একটা লুঙ্গি কিনে এনে বাড়িতে আনলার উপর রাখেন। পরেরদিন ভাতিজা চুরি করে দর্জি দোকানে নিয়ে তা গিয়ে জার্মানির পতাকা বানিয়ে নিলেন। লুঙ্গির শোকে চাচা মুহ্যমান। যখন জানতে পারলেন তার ভাতিজা এ আকাম করেছেনÑ বেচারা চাচা লুঙ্গির শোক ভুলে ভাতিজার মেধার উচ্ছসিত প্রশংসায় ভাসলেন। বললেন আমার যে ভাতিজা লুঙ্গি কেটে এ কাজ করতে পারলো ভবিষ্যতে সে অনেক মেধাবী হবে। আসলে তার ভাইপোর দোষ কি। বিশ^কাপ এলে কত বিচিত্র ঘটনাই ঘটে। যেমন ঘটেছে এক ভাবীর বেলায়। ভাবী তার বরকে হলুদ রংয়ের কাপড় নিয়ে পাঠিয়েছেন দর্জির দোকানে পেটিকোট তৈরির জন্য। তার বর এটা দিয়ে ব্রাজিলের পতাকা তৈরি করে আনলেন। ভাবীতো মহাক্ষ্যাপা। তার সাধের পেটিকোটের কাপড় এখন বাঁশের আগায়।
এক পিতা তার ছেলের জন্য আকাশি নীল রংয়ের শার্টের কাপড় পাঠালেন। ছেলে সেটা দিয়ে তৈরী করে নিলো আর্জেন্টিনার পতাকা।
গল্পের শেষ প্রান্তে এসে একটা কথা বলতে মন চায় ব্রাজিল আর্জেন্টাইনরা হারলেও তাদের দেশের মানুষ এই হারকে সুন্দরভাবে মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের দেশের তাদের সমর্থকরা এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।
তাইতো আমাদের দেশের দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি, গুতাগুতি লেগেই থাকে। এ যেন ধুন্ধমার কান্ড।
এরই নাম ফুটবল। এরই নাম আর্জেন্টিনা- ব্রাজিল, ইতালি-জার্মানি, আবাহনী-মোহামেডান। ফুটবলের এ স্নায়ুযুদ্ধ লেগেই থাকবে। এটাতে তারা শান্তি পায়। মনের আবেগ মিটায়।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » বাংলাদেশ সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ ফেনী জেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত
- » ফেনী বন্ধুসভার বৃক্ষরোপণ ও বিতরণ
- » আমার দেশ সম্পাদকের রত্নগর্ভা মাতা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের মাগফিরাত কামনায় ফেনীতে দোয়া
- » গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
- » ফেনীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাংবাদিকদের উপর হামলার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস
- » জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যানের উপর হামলা, সংবাদ সম্মেলন
- » ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন
- » ফেনীতে হেফাজতের দোয়া মাহফিলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী- ‘আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে আর ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হবে না’
- » ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফেনীতে বিএনপি’র বর্ণাঢ্য বিজয় মিছিল, সমাবেশ “গণহত্যার দ্রুত বিচার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি”
- » ফরহাদনগরে ছাত্রদল নেতা জিয়া উদ্দিনের ভয়ে বসতবাড়ি ছেড়ে পথে ঘুরছে বৃদ্ধা দুই অসহায় বোন